গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কমানোর উপায়

গর্ভাবস্থায় সমস্যা ও করনীয় অনেক বিষয় আছে যা কম বেশী সকলেই দুঃচিন্তায় থাকে, তেমনি গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কমানোর উপায় তার মধ্যে একটি। কারণ গর্ভাবস্থায় অনেকের ডায়াবেটিস পাওয়া যায়। তাই আজ এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো যাতে আপনারা এই বিষয়ে জানতে পারেন।

সুমনা রহমান, ঢাকার উত্তরা এলাকায় বসবাস করেন। তাঁর গর্ভাবস্থার সপ্তম মাসে ডাক্তার জানান, তিনি গ্যাস্টেশনাল ডায়াবেটিস-এ আক্রান্ত। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন সুমনা। তিনি ভাবতেই পারেননি গর্ভাবস্থায় এমন একটি রোগ হবে যা না শুধু তার নিজের জন্য নয়, বরং তার অনাগত সন্তানের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

তবে সুমনা হতাশ হননি। ডাক্তারের পরামর্শ, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, হালকা ব্যায়াম এবং জীবনধারায় পরিবর্তনের মাধ্যমে তিনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন, গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

এই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা আজ জানব, গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কেন হয়, এর ঝুঁকি কী, কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, এবং কোন অভ্যাসগুলো মায়েদের রক্ষা করতে পারে।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কমানোর উপায়
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কমানোর উপায়

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কী?

গ্যাস্টেশনাল ডায়াবেটিস (Gestational Diabetes Mellitus – GDM) হলো এমন একটি অবস্থা, যখন গর্ভাবস্থায় প্রথমবারের মতো রক্তে শর্করার (গ্লুকোজ) মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এটি মূলত তখনই দেখা দেয়, যখন শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে ব্যর্থ হয়, অথবা তৈরি করা ইনসুলিন ঠিকভাবে কাজ করে না।

কেন হয় গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস?

গর্ভাবস্থার সময় শরীরে বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তন ঘটে, যা ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত করে। ইনসুলিন শরীরে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন এই ইনসুলিন ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, তখন রক্তে গ্লুকোজ জমে যায়, ফলে ডায়াবেটিসের মতো সমস্যা দেখা দেয়।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকিপূর্ণ মা কারা?

নিম্নোক্ত বিষয়গুলো গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে:

  • আগে কোনো গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস থাকা
  • পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ডায়াবেটিসের ইতিহাস
  • অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা
  • ২৫ বছরের বেশি বয়স
  • আগের সন্তানের জন্ম ওজন ৪ কেজির বেশি
  • উচ্চ রক্তচাপ বা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS)

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের লক্ষণ:

গ্যাস্টেশনাল ডায়াবেটিস প্রায়ই লক্ষণহীন হয়। তবে কিছু মায়েদের মাঝে দেখা যেতে পারে:

  • অতিরিক্ত তৃষ্ণা লাগা
  • ঘন ঘন প্রস্রাব
  • অতিরিক্ত ক্ষুধা
  • দুর্বলতা বা ক্লান্তি
  • চোখে ঝাপসা দেখা

যেহেতু এই লক্ষণগুলো সাধারণ গর্ভাবস্থার ক্ষেত্রেও দেখা যায়, তাই নিয়মিত পরীক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

গর্ভাবস্থায় যোনিতে চুলকানি হলে করণীয়
গর্ভাবস্থায় যোনিতে চুলকানি হলে করণীয়

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের ক্ষতিকর প্রভাব:

যদি এটি নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তবে মায়ের এবং শিশুর উপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে:

  • শিশুর ওজন অনেক বেশি হওয়া (Macrosomia)
  • প্রসবের সময় জটিলতা
  • অপরিপক্ক জন্ম (Preterm birth)
  • নবজাতকের হাইপোগ্লাইসেমিয়া
  • ভবিষ্যতে মা ও সন্তানের টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নির্ণয়ের পদ্ধতি:

সাধারণত গর্ভাবস্থার ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (GTT) করা হয়। এটি হলো একটি রক্ত পরীক্ষা যা গ্লুকোজ সেবনের পর রক্তে শর্করার মাত্রা পরিমাপ করে। কিছু মা যাদের ঝুঁকি বেশি, তাঁদের ক্ষেত্রে আরও আগেই পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কমানোর উপায়:

1. সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করুন
  • কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত খাবার খান (যেমন: ওটস, ব্রাউন রাইস, ডাল)
  • শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে শাকসবজি, ফলমূল, প্রোটিন ও ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খান
  • মিষ্টি, সফট ড্রিংকস, প্যাকেটজাত খাবার এড়িয়ে চলুন
2. হালকা ব্যায়াম করুন
  • প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হালকা হাঁটা বা গর্ভকালীন উপযোগী যোগব্যায়াম করুন
  • একটানা বসে না থেকে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করুন
3. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন

গর্ভাবস্থার আগে ওজন বেশি থাকলে গ্যাস্টেশনাল ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। তাই গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

4. নিয়মিত রক্তে শর্করা পরীক্ষা করুন

ডাক্তার যে সময়ে পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন, তা মেনে চলা জরুরি। বাড়িতে গ্লুকোমিটার ব্যবহার করে নিজে নিজেও পরিমাপ করা যেতে পারে।

5. চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইনসুলিন বা ওষুধ গ্রহণ

অনেক সময় শুধুমাত্র খাদ্য ও ব্যায়ামে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হলে ডাক্তার ইনসুলিন ইনজেকশন দেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। এটি শিশুর জন্য নিরাপদ।

সুমনা ডাক্তার ও পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিয়ে প্রতিদিন ৩ বার হালকা হাঁটাহাঁটি করতেন, নিয়ম করে খাবার খেতেন এবং চিনি সম্পূর্ণ বাদ দেন। তিনি গর্ভাবস্থায় কোনো ইনসুলিন না নিয়েই সুস্থ সন্তান জন্ম দিয়েছেন। তাঁর মতে, “সচেতনতা আর আত্মনিয়ন্ত্রণই গর্ভকালীন ডায়াবেটিসকে হারানোর মূল অস্ত্র।”

শিশুর জন্য কী করণীয়?

  • জন্মের পর শিশুর রক্তে গ্লুকোজ পরীক্ষা করানো উচিত
  • শিশুর ওজন ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সূচক পর্যবেক্ষণ করতে হবে
  • ব্রেস্টফিডিং শুরু করলে শিশুর রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল থাকে

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ে সাধারণ প্রশ্ন (FAQs):

1. গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে কি সবসময় ইনসুলিন নিতে হয়?

না, সব ক্ষেত্রে নয়। অনেক সময় সঠিক খাবার ও ব্যায়ামের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়।

2. গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কি স্থায়ী হয়ে যায়?

প্রায় ৯০-৯৫% ক্ষেত্রে সন্তান জন্মের পর ডায়াবেটিস চলে যায়, তবে ভবিষ্যতে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

3. ডায়াবেটিস থাকলে কি স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব?

হ্যাঁ, যদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং অন্য কোনো জটিলতা না থাকে, তবে স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব।

4. গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে শিশুর কি সমস্যা হতে পারে?

শিশুর ওজন বেশি হতে পারে, শ্বাসকষ্ট বা জন্মের পর হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে।

5. কি খাবার খেলে রক্তে চিনি কমে?

কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত খাবার যেমন লাল চাল, সবজি, বাদাম, ডাল শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস এখন আর আতঙ্ক নয় যদি আপনি সঠিক সময়ে পরীক্ষা, চিকিৎসা ও খাদ্যাভ্যাসে নিয়ন্ত্রণ আনেন।

শিশুর সুস্থতা ও নিজের নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি মা’র উচিত এই রোগটি সম্পর্কে সচেতন থাকা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মনে রাখবেন, আপনার সুস্থতা মানেই আপনার সন্তানের নিরাপদ আগমন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top