জেনে নিন টিটি টিকা কেন জরুরী

গর্ভবতী হওয়ার পর করনীয় বিষয়ের মধ্যে টিটি টিকা টা ও গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এটি মা ও অনাগত সন্তানের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তাই অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় এটির ব্যাপারে ও জানা ভালো

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে মা হন নাসিমা বেগম। প্রথমবারের মতো মা হওয়ার আনন্দে তাঁর চোখে জল। তবে আনন্দের পাশাপাশি ছিল উদ্বেগও ডাক্তারের কড়া নির্দেশ, “টিটি টিকা অবশ্যই নিতে হবে।

” নাসিমা ভেবেছিলেন, এটা হয়তো সাধারণ কোনো টিকা। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মী যখন বললেন, “এই টিকাটি আপনার এবং আপনার অনাগত সন্তানের জীবন বাঁচাতে পারে,” তখন তিনি চমকে উঠলেন।

এই লেখায় আমরা জানব টিটি টিকা কী, কেন গুরুত্বপূর্ণ, কাদের দেওয়া হয়, কখন নেওয়া উচিত এবং এর প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে।

বাস্তব গল্প, তথ্য ও প্রমাণ-ভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ টিকার সম্পর্কে জানব যা বাংলাদেশের মা ও শিশুর নিরাপদ ভবিষ্যতের এক বড় হাতিয়ার।

টিটি টিকা
টিটি টিকা

টিটি টিকা কী?

টিটি টিকা হলো টেটানাস টক্সয়েড (Tetanus Toxoid) টিকা, যা টেটানাস নামক ভয়াবহ রোগের প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়। টেটানাস এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া (Clostridium tetani) দ্বারা সৃষ্ট রোগ, যা সাধারণত কাটা-ছেঁড়া বা ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এবং স্নায়ুতন্ত্রে আক্রমণ করে।

টেটানাস রোগ কতটা ভয়ানক?

টেটানাস একটি মারাত্মক ও প্রাণঘাতী রোগ, যা মূলত ক্লোস্ট্রিডিয়াম টেটানি নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ঘটে। এটি শরীরের স্নায়ুতন্ত্রে আক্রমণ করে এবং পেশির তীব্র খিঁচুনি সৃষ্টি করে। রোগীর মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে যায় (lockjaw), ফলে কথা বলা, খাওয়া বা শ্বাস নেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে।

শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা ও খিঁচুনির মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে স্যানিটেশন ও নিরাপদ প্রসবের অভাব আছে, সেখানে এই রোগের ঝুঁকি অনেক বেশি। তবে, টিটি টিকার মাধ্যমে টেটানাস শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য, তাই এটি নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

টেটানাস রোগের লক্ষণগুলো হলো:

  • পেশির খিঁচুনি
  • চোয়াল শক্ত হয়ে যাওয়া (lockjaw)
  • শ্বাসকষ্ট
  • অতিরিক্ত ঘাম
  • মৃত্যুও হতে পারে

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর কয়েক হাজার শিশু ও মায়ের মৃত্যু ঘটে শুধুমাত্র টেটানাসের কারণে। অথচ এই রোগটি পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য।

টিটি টিকার প্রয়োজনীয়তা:

বাংলাদেশে এখনও বহু নারী গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। জন্মের সময় অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, জীবাণুযুক্ত যন্ত্রপাতি কিংবা প্রশিক্ষণহীন ধাত্রীদের কারণে টেটানাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। তাই গর্ভবতী মায়েদের টিটি টিকা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

টিটি টিকা শুধুমাত্র গর্ভবতী নারীদের জন্য নয়, শিশু, কিশোর-কিশোরী, এমনকি প্রাপ্তবয়স্করাও যদি কখনো টেটানাস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েন, তাঁদের জন্যও এটি প্রযোজ্য।

গর্ভবতী নারীদের জন্য টিটি টিকার সময়সূচি:

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাইডলাইনের ভিত্তিতে, গর্ভবতী মায়েদের জন্য ৫টি ডোজে টিটি টিকা দেওয়া হয়:

  1. TT1 – গর্ভাবস্থার প্রথম সুযোগে
  2. TT2 – TT1 এর ৪ সপ্তাহ পর
  3. TT3 – TT2 এর ৬ মাস পর বা পরবর্তী গর্ভাবস্থায়
  4. TT4 – TT3 এর ১ বছর পর
  5. TT5 – TT4 এর ১ বছর পর

TT2 পর্যন্ত নিলে মায়ের ও নবজাতকের ৩ বছরের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। TT5 পর্যন্ত সম্পন্ন হলে টেটানাস থেকে আজীবনের সুরক্ষা মেলে।

গর্ভবতী নারীদের জন্য টিটি টিকা
গর্ভবতী নারীদের জন্য টিটি টিকা

টিটি টিকার নিরাপত্তা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:

টিটি টিকা অত্যন্ত নিরাপদ। তবে কিছু সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে:

  • ইনজেকশন স্থানে ব্যথা বা ফোলাভাব
  • সামান্য জ্বর
  • ক্লান্তি বা শরীর ম্যাজম্যাজে ভাব

এগুলো একেবারেই সাধারণ এবং কিছুদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। তবে যদি অস্বাভাবিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তাহলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে।

নাসিমা বেগমের গ্রামে আগে টিকা দেওয়ার চল ছিল না। প্রথম সন্তানের সময় তিনি TT2 ডোজ নিয়েছিলেন। সন্তান জন্মের পর সে ছিল একদম সুস্থ ও টানটান।

গ্রামে যখন এক প্রতিবেশীর বাচ্চা জন্মের তিনদিন পর খিঁচুনিতে মারা যায়, তখন নাসিমা বুঝতে পারেন, একটা ছোট টিকাই কত বড় রক্ষা করেছে তাঁর সন্তানকে।

এই গল্পের মতো হাজারো ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে যেখানে টিটি টিকা প্রাণ বাঁচাচ্ছে।

টিটি টিকা কোথায় পাওয়া যায়?

বাংলাদেশ সরকারের ইপিআই (Expanded Program on Immunization) এর আওতায় বিনামূল্যে টিটি টিকা প্রদান করা হয়। এটি পাওয়া যায়:

  • ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে
  • উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে
  • কমিউনিটি ক্লিনিকে
  • স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে

টিটি টিকা গ্রহণে সচেতনতা বাড়ানোর প্রয়োজন:

যদিও সরকার বিনামূল্যে টিকা দিচ্ছে, অনেক নারী এখনও সচেতন নয়। গ্রামাঞ্চলে টিকা সম্পর্কে কুসংস্কার, ভয়, এবং অজ্ঞতার কারণে অনেকেই টিটি টিকা নেন না। এখানে প্রয়োজন:

  • প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের ভূমিকা
  • মসজিদ, স্কুল, মিডিয়া ও এনজিওগুলোর সচেতনতামূলক কাজ
  • পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সহানুভূতিশীল ভূমিকা

টিটি টিকা ও শিশু মৃত্যু হ্রাস: পরিসংখ্যান

বাংলাদেশে টিটি টিকার আওতাভুক্ত মায়েদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নবজাতক মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী:

  • ২০১০ সালে নবজাতক মৃত্যুহার ছিল ৩৭ প্রতি ১০০০ জীবিত জন্মে।
  • ২০২২ সালে এই হার কমে দাঁড়ায় ২৩।

এটি প্রমাণ করে, টিকা কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করলে জীবন বাঁচানো যায়।

টিটি টিকা: পুরুষদের জন্যও জরুরি?

হ্যাঁ, বিশেষ করে যদি কেউ লোহা বা ময়লা যুক্ত কিছুর দ্বারা কাটা বা জখম হন, তবে দ্রুত টিটি টিকা নেওয়া প্রয়োজন। অনেক সময় হাসপাতাল বা চিকিৎসকের পরামর্শে বুস্টার ডোজ নেওয়া হয়, যাতে সংক্রমণ রোধ করা যায়।

টিটি টিকা সম্পর্কে সাধারণ প্রশ্ন (FAQs)

1. টিটি টিকা না নিলে কী হতে পারে?

আপনি বা আপনার নবজাতক টেটানাসে আক্রান্ত হতে পারেন, যা মারাত্মক হতে পারে এবং মৃত্যুর সম্ভাবনাও থাকে।

2. গর্ভকালীন সময়ে টিটি টিকা নেওয়া নিরাপদ?

হ্যাঁ, এটি নিরাপদ এবং গর্ভাবস্থায় নেওয়া উচিত।

3. টিটি টিকা একবার নিলে কি চিরজীবনের জন্য সুরক্ষা দেয়?

না, চিরজীবনের জন্য সুরক্ষা পেতে হলে TT5 পর্যন্ত সম্পন্ন করতে হয়।

4. কি কি ক্ষেত্রে পুনরায় টিটি টিকা নেওয়া দরকার?

কোনো কাটা-ছেঁড়া, দুর্ঘটনা বা অপারেশন হলে চিকিৎসকের পরামর্শে টিটি টিকা নেওয়া দরকার হতে পারে।

5. টিটি টিকা কিশোরীদের দেওয়া হয় কেন?

কিশোরীদের ভবিষ্যতে মা হওয়ার আগেই প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে টিটি টিকা দেওয়া হয়।

একটি ছোট টিটি টিকা শুধু একটি মায়ের জীবন নয়, একটি নতুন প্রাণের নিরাপদ আগমন নিশ্চিত করে। আমাদের উচিত নিজে সচেতন হওয়া, পরিবার-পরিজনকে সচেতন করা এবং আশেপাশের লোকদের টিকা নিতে উৎসাহিত করা।

স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। আর টিটি টিকা সেই স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top