আলট্রাসনোগ্রাফি কী ও এর বিস্তারিত

গর্ভাবস্থায় অনেকে অনেক বিষয় নিয়ে জানতে আগ্রহী থাকে তারমধ্যে আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও অন্যতম। গর্ভবতী হওয়ার পর করনীয়গর্ভাবস্থায় সমস্যা ও করনীয় হিসেবে এইগুলো সম্পর্কে জানা ভালো

রুমা বেগম, ২৮ বছর বয়সী একজন গৃহিণী। এটি তার প্রথম সন্তান। প্রথম তিন মাসে হঠাৎ করে তার পেটে ব্যথা শুরু হয়। পরিবারের সবাই চিন্তায় পড়ে যায়। ডাক্তার পরামর্শ দেন আল্ট্রাসনোগ্রাম” করার। প্রথমে ভয় পেলেও, রিপোর্টের পর জানা যায় – সবকিছু স্বাভাবিক। এই একটি পরীক্ষা তার পুরো গর্ভাবস্থার গতি নির্ধারণ করে দেয়।

এই লেখাটিতে আমরা জানবো আল্ট্রাসনোগ্রাম কী, কেন এটি করা হয়, বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় এর গুরুত্ব, এবং আরও অনেক কিছু।

আলট্রাসনোগ্রাফি কী?

আল্ট্রাসনোগ্রাম, যাকে আমরা “সোনোগ্রাফি” নামেও চিনি, একটি নিরাপদ ও ব্যথাহীন ইমেজিং প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শরীরের ভিতরের অঙ্গগুলোর ছবি তৈরি করা হয়। এটি উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে কাজ করে, যার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।

আলট্রাসনোগ্রাফি
আলট্রাসনোগ্রাফি

আল্ট্রাসনোগ্রামের কাজ কী?

  • শরীরের ভেতরের বিভিন্ন অঙ্গ, যেমন লিভার, কিডনি, গলব্লাডার, প্রোস্টেট ইত্যাদির অবস্থা নির্ণয়
  • গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে ভ্রূণের বৃদ্ধি, পজিশন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা
  • পেটে ব্যথা বা অস্বস্তির কারণ খুঁজে বের করা
  • টিউমার, সিস্ট, গলস্টোন বা ফাইব্রয়েড সনাক্তকরণ

আল্ট্রাসনোগ্রাম কিভাবে কাজ করে?

যখন প্রোব বা ট্রান্সডিউসার ত্বকে রাখা হয়, তখন তা থেকে উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তরঙ্গ বের হয়। এই তরঙ্গ শরীরের ভেতরের অঙ্গগুলোতে আঘাত করে ফিরে আসে, এবং সেগুলো কম্পিউটার স্ক্রিনে ছবি আকারে প্রদর্শিত হয়।

আল্ট্রাসনোগ্রামের ধরন

১. অ্যাবডোমিনাল আল্ট্রাসনোগ্রাম

পেটের ওপর দিয়ে করা হয়। সাধারণত গর্ভাবস্থায় এটি বেশি ব্যবহার হয়।

২. ট্রান্সভ্যাজাইনাল আল্ট্রাসনোগ্রাম

মহিলাদের ক্ষেত্রে যোনিপথে প্রোব প্রবেশ করিয়ে করা হয়। গর্ভাবস্থার শুরুতে এটি ব্যবহার হয়।

৩. ডপলার আল্ট্রাসনোগ্রাম

রক্তপ্রবাহ ও হৃদস্পন্দন পরিমাপ করতে ব্যবহৃত হয়।

৪. 3D ও 4D আল্ট্রাসনোগ্রাম

ভ্রূণের স্পষ্ট থ্রিডি চেহারা বা লাইভ মুভমেন্ট দেখা যায়।

জানুন গর্ভাবস্থায় কি কি সমস্যা হয়
জানুন গর্ভাবস্থায় কি কি সমস্যা হয়

গর্ভাবস্থায় আল্ট্রাসনোগ্রাম কেন করা হয়?

গর্ভাবস্থায় এটি করা হয় ভ্রূণের সঠিক বৃদ্ধি, অবস্থান, ও স্বাস্থ্য নিরীক্ষণের জন্য। এটি গর্ভকালীন ঝুঁকি নির্ধারণে সাহায্য করে।

গর্ভাবস্থায় আল্ট্রাসনোগ্রামের প্রধান কারণগুলো:

  • ভ্রূণের হার্টবিট ও অঙ্গের গঠন দেখা
  • যমজ বা একাধিক সন্তান আছে কিনা তা নিশ্চিত করা
  • গর্ভফুল (Placenta) এর অবস্থান নির্ধারণ
  • গর্ভকাল নির্ধারণ ও ডেলিভারির তারিখ অনুমান
  • কোনো ত্রুটি বা জন্মগত সমস্যা আছে কিনা যাচাই

কোন কোন সময়ে গর্ভাবস্থায় আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হয়?

গর্ভকালউদ্দেশ্য
৬-৮ সপ্তাহগর্ভধারণ নিশ্চিত করা, হার্টবিট দেখা
১১-১৪ সপ্তাহপ্রথম ত্রৈমাসিক স্ক্রিনিং, জন্মগত ত্রুটি শনাক্ত
১৮-২২ সপ্তাহঅঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন, লিঙ্গ নির্ধারণ (যেখানে আইনসিদ্ধ)
৩২-৩৬ সপ্তাহভ্রূণের ওজন, অবস্থান ও প্লাসেন্টার অবস্থা

আল্ট্রাসনোগ্রাম করার আগে কী প্রস্তুতি দরকার?

  • পরীক্ষার আগে পর্যাপ্ত পানি খাওয়া জরুরি, যাতে ব্লাডার পূর্ণ থাকে
  • পরীক্ষার সময় আরামদায়ক পোশাক পরা ভালো
  • ট্রান্সভ্যাজাইনাল আল্ট্রাসনোগ্রামের ক্ষেত্রে প্রস্রাব করে যেতে হয়

আল্ট্রাসনোগ্রামের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি?

না। আল্ট্রাসনোগ্রাম সম্পূর্ণ নিরাপদ। এটি তেজস্ক্রিয়তা ব্যবহার করে না, ফলে গর্ভাবস্থায় এটি ব্যবহার করা নিরাপদ। এখন পর্যন্ত গবেষণায় কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পাওয়া যায়নি।

আল্ট্রাসনোগ্রাম নিয়ে সাধারণ ভুল ধারণা

  • অনেকেই ভাবেন এটি করলে শিশুর ক্ষতি হতে পারে এটি সম্পূর্ণ ভুল।
  • অনেকে ভাবেন সবসময় লিঙ্গ দেখা যায় বাস্তবে, অনেক সময় ভ্রূণের অবস্থান অনুযায়ী তা সম্ভব হয় না।
  • কেউ কেউ মনে করেন অনেকবার করলে সমস্যা হয় আধুনিক গবেষণা বলছে বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহারে এটি নিরাপদ।

বাংলাদেশে আল্ট্রাসনোগ্রামের খরচ কত?

বাংলাদেশে এটি সাধারণত ৫০০ থেকে ২০০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। তবে ক্লিনিক ও হাসপাতালের মান অনুযায়ী ভিন্নতা থাকে।

গর্ভাবস্থায় আল্ট্রাসনোগ্রাম না করলে কী হতে পারে?

  • সন্তান প্রসবের সময় ঝুঁকি বাড়তে পারে
  • কোনো জন্মগত ত্রুটি আগে থেকে জানা সম্ভব হয় না
  • গর্ভপাত বা একটোপিক প্রেগন্যান্সির ঝুঁকি শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে

আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে যেসব তথ্য জানা যায়

  • ভ্রূণের সংখ্যা ও স্বাস্থ্য
  • শিশুর অবস্থান (মাথা নিচে নাকি উপরে)
  • প্লাসেন্টার অবস্থা
  • গর্ভজলের পরিমাণ
  • ভ্রূণের হৃৎস্পন্দন ও গতিবিধি

FAQ: সাধারণ জিজ্ঞাসা

আল্ট্রাসনোগ্রাম কি বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর?

না, এটি পুরোপুরি নিরাপদ এবং গর্ভাবস্থায় এটি নিয়মিত ব্যবহৃত হয়।

কয়বার আল্ট্রাসনোগ্রাম করা নিরাপদ?

ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী ৩-৫ বার সাধারণত যথেষ্ট হয়।

আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে কি বাচ্চার লিঙ্গ জানা যায়?

হ্যাঁ, ১৮-২২ সপ্তাহে জানা যায়, তবে বাংলাদেশে আইনত এটি নিষিদ্ধ।

ট্রান্সভ্যাজাইনাল আল্ট্রাসনোগ্রাম কি ব্যথাদায়ক?

না, এটি সামান্য অস্বস্তিকর হলেও ব্যথাহীন।

আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট বুঝবো কীভাবে?

রিপোর্টের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হলে ডাক্তার ব্যাখ্যা করবেন। কখনোই নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।

আলট্রাসনোগ্রাফি কী ও এর বিস্তারিত শুধুমাত্র একটি টেস্ট নয়, এটি মায়ের ও শিশুর জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অন্যতম প্রধান উপায়। গর্ভাবস্থার প্রতিটি পর্যায়ে এর গুরুত্ব অপরিসীম। ভুল ধারণা নয়, সঠিক তথ্য নিয়ে সিদ্ধান্ত নিন – স্বাস্থ্যই হোক আপনার সবচেয়ে বড় সম্পদ।

আপনার যদি আলট্রাসনোগ্রাফি কী ও এর বিস্তারিত সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন থাকে, কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না , আমরা যথাসাধ্য সাহায্য করবো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top