গর্ভধারণের প্রথম তিন মাস যে সময়টা সবচেয়ে বেশি আনন্দের, আবার সবচেয়ে বেশি ভয়ের ও। মা হওয়ার অনুভূতি অসাধারণ, কিন্তু সেই সাথে আসে অনেক দুশ্চিন্তা। বিশেষ করে গর্ভাবস্থার প্রথম ৩ মাস অত্যন্ত সংবেদনশীল সময়। এই সময়ে ভুল কোনো সিদ্ধান্ত বা অসাবধানতা আপনার সন্তানের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
আমার এক বন্ধু, রিমা, যখন প্রথমবার মা হতে যাচ্ছিল, তখন তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কিন্তু চ্যালেঞ্জিং সময় ছিল প্রথম তিন মাস। সে সবসময় ভয়ে থাকতো, ঠিকভাবে খাচ্ছে কি না, বিশ্রাম নিচ্ছে কি না সব কিছুতেই ছিল অস্থিরতা। সে একদিন অফিসের কাজের চাপে এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে রক্তপাত শুরু হয়। ডাক্তার বলেছিলেন, “সতর্ক না হলে বড় বিপদ হতে পারতো।”
এই নিবন্ধে আমরা আলোচনা করবো গর্ভাবস্থায় প্রথম ৩ মাসের সতর্কতা, কীভাবে এই সময়টি নিরাপদে পার করা যায়, এবং কোন কোন বিষয়ের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। আপনার যদি গর্ভধারণের প্রথম দিকে থাকেন, তাহলে এটি আপনার জন্য অবশ্যই পড়ার মতো।
গর্ভাবস্থায় প্রথম ৩ মাসের সতর্কতা কেন সংবেদনশীল?
গর্ভাবস্থার প্রথম ৩ মাসকে বলা হয় প্রথম ট্রাইমেস্টার। এই সময়ে শিশুর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলি গঠিত হতে থাকে। বিশেষ করে হৃদপিণ্ড, মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের গঠন এই সময়ে সম্পূর্ণ হয়।
স্ট্যাটিস্টিক্স অনুযায়ী, ৮০% গর্ভপাত ঘটে এই প্রথম তিন মাসে। তাই এই সময়ে বাড়তি সতর্কতা এবং যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথম ৩ মাসে করণীয় বিষয়সমূহ:
১. সঠিক পুষ্টি গ্রহণ
প্রথম তিন মাসে সঠিক পুষ্টির অভাব হলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। আপনার খাদ্যতালিকায় অবশ্যই প্রোটিন, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম এবং আয়রন অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।
২. বিশ্রাম নেওয়া
অতিরিক্ত কাজ বা ক্লান্তি গর্ভস্থ শিশুর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। রিমার অভিজ্ঞতাই তার প্রমাণ। প্রতিদিন অন্তত ৮ ঘণ্টা ঘুম এবং বিশ্রাম নিশ্চিত করতে হবে।
৩. মানসিক চাপ কমানো
মনের চাপ গর্ভাবস্থার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। বিশেষ করে প্রথম ৩ মাসে মানসিক শান্তি বজায় রাখা খুবই জরুরি। যোগব্যায়াম বা মেডিটেশন এতে সহায়ক হতে পারে।
৪. নিয়মিত চেকআপ করানো
ডাক্তারের পরামর্শ মেনে নিয়মিত চেকআপ করা অত্যন্ত জরুরি। এটি নিশ্চিত করে যে আপনার গর্ভস্থ শিশুটি সুস্থভাবে বেড়ে উঠছে।
৫. ওষুধ সেবনে সতর্কতা
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে প্রথম তিন মাসে ওষুধের প্রভাব অনেক বেশি হতে পারে।

আরও সতর্কতা যেগুলো অবশ্যই মানতে হবে:
৬. ভারী কাজ এড়িয়ে চলুন
এই সময় ভারী কিছু বহন করা বা অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম করা একেবারেই উচিত নয়। এটি শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
৭. ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করুন
গর্ভাবস্থায় ধূমপান বা অ্যালকোহল সেবন করলে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে এবং গর্ভপাতের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। তাই এগুলো একেবারে পরিহার করা উচিত।
৮. কাঁচা বা অপরিষ্কার খাবার এড়িয়ে চলুন
কাঁচা মাছ, কাঁচা ডিম, অপাস্তুরিত দুধ বা অপরিষ্কার খাবার খেলে গর্ভের শিশুর সংক্রমণ হতে পারে, যা মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে।
৯. অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ করবেন না
চা, কফি বা সফট ড্রিঙ্কস থেকে অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ করলে গর্ভের শিশুর ওজন কমে যেতে পারে এবং গর্ভপাতের সম্ভাবনাও বাড়তে পারে।
১০. পর্যাপ্ত পানি পান করুন
শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা জরুরি। পানিশূন্যতা গর্ভের শিশুর বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, তাই প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।

সাধারণ সমস্যা ও তার সমাধান:
মর্নিং সিকনেস:
প্রথম তিন মাসে মর্নিং সিকনেস একটি সাধারণ সমস্যা। প্রায় ৭০% গর্ভবতী নারী এতে আক্রান্ত হন। সাধারণত এটি দিনের শুরুর দিকে বেশি দেখা দেয়।
সমাধান:
- ছোট ছোট করে খাবার খাওয়া।
- বেশি তেল-মসলাযুক্ত খাবার এড়ানো।
- আদা চা বা লেবুর রস খাওয়া।
অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সতর্কতা:
রিমার গল্প থেকেই আমরা শিখেছি যে, গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে অতিরিক্ত কাজ করা বা বিশ্রামের অভাব বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই কাজের চাপ কমিয়ে, সঠিকভাবে বিশ্রাম নিয়ে এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়া অত্যন্ত জরুরি।
গর্ভাবস্থার প্রথম ৩ মাস সত্যিই খুব সংবেদনশীল সময়। এই সময়ে সঠিক যত্ন ও সতর্কতা না নিলে বড় বিপদ ঘটতে পারে। আপনি যদি মা হতে যাচ্ছেন, তাহলে দয়া করে নিজের প্রতি যত্নশীল হন। মনে রাখবেন, আপনার সুখ আর শান্তিই আপনার সন্তানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।