গর্ভাবস্থায় বাচ্চার হার্টবিট কমে গেলে করণীয়

রাত তখন ১১টা, রিয়া আতঙ্কে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন। মাত্র ৭ মাসের গর্ভবতী তিনি। আজ ডাক্তারের চেকআপে জানতে পেরেছেন, তার সন্তানের হার্টবিট স্বাভাবিকের চেয়ে কম। আতঙ্কে তিনি চোখের জল আটকাতে পারছেন না।

তিনি ভাবছেন, “এটা কি খুব বিপজ্জনক? আমার বাচ্চা কি ঠিক থাকবে? আমি এখন কী করবো?” ডাক্তার তাকে শান্ত থাকতে বলেছেন, কিন্তু মনের ভিতর হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

আপনার সঙ্গেও এমন কিছু ঘটলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। হার্টবিট কমে যাওয়া কখনও কখনও সাময়িক হতে পারে এবং কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করলে এটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। গর্ভাবস্থায় সমস্যা ও করনীয় এর আলোকে আজকের আমরা গর্ভাবস্থায় বাচ্চার হার্টবিট কমে গেলে কী করণীয়, কারণ ও প্রতিরোধের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো

গর্ভাবস্থায় বাচ্চার হার্টবিট কখন কম মনে করা হয়?

সাধারণত গর্ভাবস্থায় শিশুর হার্টবিট ১১০-১৬০ বিট পার মিনিট (BPM) হওয়া স্বাভাবিক। যদি এটি ১১০ BPM-এর নিচে নেমে যায়, তাহলে ডাক্তার এটিকে ফেটাল ব্র্যাডিকার্ডিয়া (Fetal Bradycardia) হিসেবে চিহ্নিত করেন।

সপ্তাহ ভিত্তিক শিশুর স্বাভাবিক হার্টবিট:

  • ৬-৭ সপ্তাহ: ৯০-১১০ BPM
  • ৮-১০ সপ্তাহ: ১৭০ BPM পর্যন্ত (সর্বোচ্চ থাকে)
  • ১১-২০ সপ্তাহ: ১৪০-১৬০ BPM
  • ২১-৪০ সপ্তাহ: ১১০-১৬০ BPM

যদি হার্টবিট এই স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম হয়, তবে এটি একটি সতর্কবার্তা হতে পারে।

সপ্তাহ ভিত্তিক শিশুর স্বাভাবিক হার্টবিট
সপ্তাহ ভিত্তিক শিশুর স্বাভাবিক হার্টবিট

গর্ভাবস্থায় বাচ্চার হার্টবিট কমে যাওয়ার কারণ

বাচ্চার হার্টবিট কমে যাওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে, যেমন:

১. অক্সিজেনের অভাব

গর্ভে শিশুর অক্সিজেন কম পৌঁছালে তার হার্টবিট ধীরে যেতে পারে। এটি সাধারণত গর্ভফুলের (Placenta) কার্যকারিতা কমে গেলে বা নাড়ির (Umbilical Cord) সমস্যার কারণে হতে পারে।

২. মায়ের স্বাস্থ্যগত সমস্যা
  • উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension)
  • রক্তশূন্যতা (Anemia)
  • থাইরয়েড সমস্যা
  • ডায়াবেটিস
৩. কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ গ্রহণ

যদি মা বেটা-ব্লকার (Beta-Blocker) বা অন্য কোনো হার্টের ওষুধ গ্রহণ করেন, তাহলে এটি শিশুর হার্টবিট কমিয়ে দিতে পারে।

৪. ইনফেকশন বা জ্বর

মায়ের শরীরে কোনো গুরুতর সংক্রমণ বা উচ্চমাত্রার জ্বর থাকলে শিশুর হার্টবিট প্রভাবিত হতে পারে।

৫. এমনিওটিক ফ্লুইডের সমস্যা

যদি গর্ভের পানি (Amniotic Fluid) স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে, তাহলে শিশুর অক্সিজেন সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় বাচ্চার হার্টবিট কমে গেলে করণীয় :

১. দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন

যদি শিশুর হার্টবিট কমে যায়, তবে দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখানো উচিত। ডাক্তার NST (Non-Stress Test) বা ডপলার আল্ট্রাসাউন্ড করে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করবেন।

২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন

শরীরকে শান্ত রাখুন এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন। শুয়ে থাকার সময় বাম দিকে কাত হয়ে শোওয়া শিশুর রক্তপ্রবাহ বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।

৩. পর্যাপ্ত পানি পান করুন

ডিহাইড্রেশন হলে শিশুর হার্টবিট কমতে পারে। তাই প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।

৪. স্বাস্থ্যকর খাবার খান

পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন, বিশেষ করে আয়রন ও প্রোটিনযুক্ত খাবার। রক্তস্বল্পতা থাকলে ডাক্তার নির্দেশিত আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করুন।

৫. অক্সিজেন সাপোর্ট নিতে হতে পারে

যদি শিশুর অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়, তাহলে ডাক্তার হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে পারেন।

৬. স্ট্রেস কমান

মানসিক চাপ থাকলে শরীরের কর্টিসল হরমোন বৃদ্ধি পায়, যা শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। মেডিটেশন, গভীর শ্বাস নেওয়া এবং ইতিবাচক চিন্তা করা এই সময় গুরুত্বপূর্ণ।

গর্ভাবস্থায় বাচ্চার হার্টবিট কমে যাওয়া নিয়ে সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)

১. গর্ভাবস্থায় শিশুর হার্টবিট কম থাকলে কি স্বাভাবিক জন্ম সম্ভব?

এটি শিশুর স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করে। যদি ডাক্তার মনে করেন ঝুঁকি বেশি, তাহলে সিজারিয়ান ডেলিভারি (C-section) করতে হতে পারে।

২. কীভাবে বুঝবো শিশুর হার্টবিট কমছে?

সাধারণত এটি ডাক্তার চেকআপে ধরা পড়ে। তবে যদি আপনার গর্ভের নড়াচড়া হঠাৎ কমে যায়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারকে জানান।

৩. বাচ্চার হার্টবিট কম থাকলে কি গর্ভপাতের ঝুঁকি আছে?

প্রথম তিন মাসে হার্টবিট খুব কম থাকলে গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকতে পারে। তবে পরবর্তী ধাপে সঠিক চিকিৎসায় সুস্থ শিশুর জন্ম সম্ভব।

রিয়ার মতো যদি আপনারও কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত ডাক্তার দেখান। গর্ভাবস্থায় বাচ্চার হার্টবিট কমে গেলে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুর স্বাভাবিক জন্ম সম্ভব।

তাই সচেতন থাকুন, নিয়মিত চেকআপ করুন, আর নিজের যত্ন নিন কারণ মা সুস্থ থাকলে বাচ্চাও সুস্থ থাকবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top