গর্ভাবস্থায় আলট্রা করানোর পর অনেকেই বাচ্চার হার্টবিট কত হলে ছেলে সন্তান হবে নাকি মেয়ে সন্তান হবে এই বিষয়ে জানতে চাই তাদের জন্য নিম্নের আলোচনা যেখানে বিস্তারিত জানতে পারবেন। এই বিষয় প্রকৃত সত্য জানা ভালো।
রুমানার বয়স ২৬ বছর। প্রথমবার মা হতে যাচ্ছেন তিনি। চার মাসের আলট্রাসনোগ্রাম করার পর চিকিৎসক জানান যে, বাচ্চার হার্টবিট মিনিটে ১৩৭। পরিবারের সবাই তখন বলাবলি শুরু করলেন, “এই হার্টবিট হলে তো ছেলে হবে!” রুমানা অবাক হয়ে ভাবলেন, হার্টবিট দিয়ে কীভাবে ছেলে না মেয়ে হয় বোঝা যায়? তিনি গুগলে খুঁজলেন, ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করলেন, এবং জানতে চাইলেন আসলে সত্যিটা কী।
এই বাস্তব গল্পটি আজকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে আমরা বাচ্চার হার্টবিটের হার অনুযায়ী লিঙ্গ নির্ধারণের সম্ভাবনা, বিজ্ঞান, বাস্তবতা এবং ভুল ধারণা সবকিছুর গভীরে যাবো।

বাচ্চার হার্টবিট কি আসলে লিঙ্গ নির্ধারণ করে?
অনেকেই মনে করেন যে গর্ভে থাকা শিশুর হার্টবিট যদি একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার নিচে বা উপরে হয়, তাহলে সেটা ছেলে না মেয়ে বোঝা যায়। এই ধারণাটি বহু বছর ধরে জনপ্রিয় হয়ে আছে, বিশেষ করে লোককথা ও পারিবারিক বিশ্বাসের মধ্যে।
কিন্তু বিজ্ঞান কী বলে? এটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে হার্টবিট কত হয়?
একটি সাধারণ মতবাদ অনুযায়ী, যদি গর্ভের শিশুর হার্টবিট ১৪০ বিট প্রতি মিনিট (bpm) এর কম হয়, তাহলে বলা হয় যে সেটা ছেলে সন্তান হতে পারে। আবার, যদি bpm ১৪০ এর উপরে হয়, তখন অনেকে মনে করেন সেটা মেয়ে সন্তান হবে।
তবে বাস্তবে দেখা গেছে, এই তথ্যের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
গর্ভাবস্থায় বাচ্চার স্বাভাবিক হার্টবিট কত হওয়া উচিত?
গর্ভাবস্থায় বাচ্চার হার্টবিট বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। এখানে একটি গড় হিসেবে হার্টবিট রেঞ্জ দেওয়া হলো:
গর্ভকাল | গড় হার্টবিট রেঞ্জ (bpm) |
---|---|
৬-৭ সপ্তাহ | ৯০-১১০ bpm |
৮-১০ সপ্তাহ | ১২০-১৬০ bpm |
১১-১৪ সপ্তাহ | ১১০-১৬০ bpm |
১৫ সপ্তাহ ও পরবর্তীতে | ১১০-১৫০ bpm |
এই তথ্য গর্ভাবস্থার জন্য চিকিৎসা সংস্থাগুলোর দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী এবং আলট্রাসনোগ্রাফি ও ফিটাল মনিটরিং রিপোর্ট থেকে সংগৃহীত।
হার্টবিট ও লিঙ্গ নির্ধারণ নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা কী বলছে?
যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক হাসপাতাল ও মেডিকেল গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমন Mayo Clinic এবং National Institutes of Health, তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে:
- শিশুর হার্টবিট গতি ছেলে বা মেয়ে হওয়াকে নির্ভরযোগ্যভাবে বোঝাতে পারে না।
- গর্ভাবস্থার শুরুতে মেয়েদের হার্টবিট কিছুটা বেশি হতে পারে, তবে সময়ের সঙ্গে তা ছেলে ও মেয়ের ক্ষেত্রে প্রায় সমান হয়ে যায়।
- প্রায় ১০০০ এর বেশি গর্ভবতী নারী নিয়ে করা গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে যে, হার্টবিট হার দিয়ে লিঙ্গ নির্ধারণ করার সফলতা ৫০% মানে একদম অনুমান ভিত্তিক।

তাহলে কেন এই ভুল ধারণা প্রচলিত?
এই ধারণার শুরু মূলত লোককথা, সমাজিক বিশ্বাস ও পারিবারিক অভিজ্ঞতা থেকে। কিছু মা হয়তো দেখেছেন যে ছেলের ক্ষেত্রে হার্টবিট একটু কম ছিল তবে তা এক বা দুই ঘটনার ভিত্তিতে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে না।
এটি একটি confirmation bias মানে আপনি যেটা বিশ্বাস করতে চান সেটার পক্ষে প্রমাণ খুঁজে নেন এবং বিপরীত তথ্য উপেক্ষা করেন।
অন্য কোন উপায়ে গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ সম্ভব?
বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ভরযোগ্য কিছু পদ্ধতি আছে যেগুলো ব্যবহার করে শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ সম্ভব:
- NIPT (Non-Invasive Prenatal Testing):
- ৯-১০ সপ্তাহেই করা যায়
- মা’র রক্তের মাধ্যমে ডিএনএ বিশ্লেষণ করে
- ৯৯% নির্ভুলতা
- Chorionic Villus Sampling (CVS):
- ১০-১৩ সপ্তাহে করা যায়
- প্লাসেন্টার কোষ সংগ্রহ করে জেনেটিক এনালাইসিস
- Amniocentesis:
- ১৫-২০ সপ্তাহে
- অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইড সংগ্রহ করে পরীক্ষার মাধ্যমে লিঙ্গ নির্ধারণ
- Ultrasound:
- সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি
- সাধারণত ১৮-২২ সপ্তাহের মধ্যে লিঙ্গ শনাক্ত করা যায়
হার্টবিট ছাড়াও ছেলে সন্তান বোঝার আরও কিছু মিথ:
নিচে কিছু জনপ্রিয় ভুল ধারণা দেওয়া হলো:
- গর্ভাবস্থায় মা’র পেটের আকার গোল হলে ছেলে
- বমি কম হলে ছেলে
- মিষ্টি খাবার খেতে ইচ্ছে করলে ছেলে
- মায়ের মুখে উজ্জ্বলতা থাকলে ছেলে
এইসব ধারণা গুলোতে কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এগুলো কেবলই কল্পনাপ্রসূত এবং সমাজে প্রচলিত লোককথা।
বাচ্চার হার্টবিটের পরিবর্তন কী কারণে হতে পারে?
শিশুর হার্টবিট বিভিন্ন কারণে কমবেশি হতে পারে, যেমন:
- জরায়ুর অক্সিজেন সরবরাহের হেরফের
- মা’র মানসিক চাপ ও খাওয়ার অভ্যাস
- বাচ্চার ঘুম বা জেগে থাকা অবস্থা
- চিকিৎসা সংক্রান্ত কোন সমস্যা
তাই হার্টবিট দেখে লিঙ্গ বোঝার চেষ্টা না করে বরং হার্টবিট স্বাভাবিক আছে কি না সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

বাচ্চার হার্টবিট কত হলে ছেলে সন্তান:
অনেকের ধারণা, গর্ভে থাকা বাচ্চার হার্টবিট যদি প্রতি মিনিটে ১৪০-এর কম হয়, তাহলে সেটা ছেলে সন্তান হতে পারে। আবার ১৪০-এর বেশি হলে মেয়ে হবে এমন বিশ্বাসও প্রচলিত। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে এই ধারণার কোনো প্রমাণ নেই।
গর্ভাবস্থার শুরুতে শিশুর হার্টবিট স্বাভাবিকভাবেই দ্রুত থাকে এবং তা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। লিঙ্গ নির্ধারণে হার্টবিট নির্ভরযোগ্য নয়। আলট্রাসনোগ্রাম, NIPT বা জেনেটিক টেস্টিং-ই একমাত্র নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি। তাই হার্টবিট দিয়ে ছেলে বা মেয়ে নির্ধারণ না করে, শিশুর সুস্থতা ও বিকাশের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
চিকিৎসকরা কী বলেন?
প্রখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে:
“হার্টবিট দিয়ে লিঙ্গ নির্ধারণ করা বৈজ্ঞানিকভাবে অবৈধ এবং ভুল। এটা গর্ভবতী নারীর মানসিক বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে।” – ডা. নাজমুন নাহার, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ
তাই চিকিৎসকদের পরামর্শ হলো, শিশুর স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ দিন, লিঙ্গ নির্ধারণ নয়।
FAQ: আপনি যা জানার জন্য সবচেয়ে বেশি খোঁজেন
১. বাচ্চার হার্টবিট ১৩৭ হলে কি ছেলে হবে?
না, হার্টবিট ১৩৭ bpm হলে ছেলে বা মেয়ে হওয়ার সম্ভাবনা ৫০%-৫০%। এটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি নয়।
২. আলট্রাসনোগ্রামে বাচ্চার লিঙ্গ কখন বোঝা যায়?
সাধারণত ১৮-২২ সপ্তাহে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, তবে ১৬ সপ্তাহের পর থেকেই কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
৩. হার্টবিট কম বা বেশি হলে কি কোনো ঝুঁকি আছে?
যদি হার্টবিট ১১০-এর নিচে বা ১৬০-এর ওপরে দীর্ঘ সময় থাকে, তাহলে ডাক্তার পরামর্শ নিতে হবে।
৪. ছেলে সন্তান বোঝার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় কী?
NIPT টেস্ট ও আলট্রাসনোগ্রাম এই দুই পদ্ধতি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য।
গর্ভের শিশুর হার্টবিট দিয়ে ছেলে না মেয়ে বোঝার চেষ্টা একটি জনপ্রিয় কিন্তু ভুল ধারণা। হার্টবিট গতি গর্ভকালীন স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এটি লিঙ্গ নির্ধারণের উপায় নয়।
সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে এগিয়ে চলুন, মিথ্যে ধারণায় বিভ্রান্ত হবেন না। আপনার শিশুর স্বাস্থ্যই সবার আগে। ছেলে হোক বা মেয়ে, তার সুস্থতা, নিরাপদ প্রসব, আর আপনাদের ভালোবাসাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
