জানুন সিজারের কতদিন পর সেলাই শুকায়

রাত তখন প্রায় তিনটা। মেঘলা চোখে লাবণী হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন, পাশে নবজাতক ছেলে ঘুমিয়ে আছে। মাত্র দুই দিন আগে সিজারিয়ান সেকশনের (C-section) মাধ্যমে তার সন্তান জন্ম নিয়েছে। শরীরে এখনও ব্যথা, হাঁটতে গেলেই মনে হয় পেটের সেলাই খুলে যাবে। তিনি উদ্বিগ্ন “সিজারের সেলাই কতদিনে শুকাবে? আমি কবে আগের মতো চলাফেরা করতে পারবো?”

এটি শুধু লাবণীর প্রশ্ন নয়, পৃথিবীর লাখো নতুন মায়ের একই উদ্বেগ। তাই আজ আমরা আলোচনা করবো, সিজারিয়ান অপারেশনের সেলাই ঠিক হতে কতদিন লাগে, কীভাবে যত্ন নিতে হবে এবং কোন বিষয়গুলো জানা জরুরি।

সিজারিয়ান অপারেশনের পর

সিজারের কতদিন পর সেলাই শুকায়:

সিজারিয়ান অপারেশনের পর সেলাই শুকাতে সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগে, তবে পুরোপুরি ভেতর থেকে নিরাময় হতে প্রায় ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

তবে এটি নির্ভর করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে:

  • মায়ের শারীরিক অবস্থা – ডায়াবেটিস বা অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে নিরাময় ধীরগতিতে হতে পারে।
  • যত্নের ধরন – সঠিকভাবে যত্ন নিলে সেলাই দ্রুত শুকায়।
  • অপারেশনের ধরন – সেলাইয়ের জন্য শুষ্ক স্ট্রিপ, সেলাই সুতো বা স্ট্যাপল ব্যবহার করা হয়েছে কিনা তার উপরও নির্ভর করে।
  • খাবার ও পুষ্টি – প্রোটিন, ভিটামিন সি ও আয়রনযুক্ত খাবার দ্রুত নিরাময়ে সহায়তা করে।

সিজারের পর সেলাইয়ের যত্ন নেওয়ার উপায়

সঠিক যত্ন না নিলে সেলাই আক্রান্ত হতে পারে, যা পরবর্তী সময়ে জটিলতা তৈরি করতে পারে। তাই নিচের কিছু বিষয় মেনে চলা উচিত:

১. পরিষ্কার ও শুকনো রাখা

সিজারের ক্ষত স্থান শুষ্ক ও পরিষ্কার রাখা অত্যন্ত জরুরি। প্রতিবার গোসলের পরে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে হালকা চেপে পানি শুষে নিতে হবে।

২. ভারী কাজ বা হঠাৎ ঝুঁকে পড়া এড়ানো

সিজারের পর অন্তত ৬ সপ্তাহ ভারী কাজ করা যাবে না। হঠাৎ ঝুঁকে পড়লে বা অতিরিক্ত চাপে সেলাই ফেটে যেতে পারে।

৩. স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া

দ্রুত নিরাময়ের জন্য খাবারে প্রোটিন, শাকসবজি, ডাল, দুধ, ডিম, মাছ রাখতে হবে। পর্যাপ্ত পানি পান করাও গুরুত্বপূর্ণ।

৪. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া

পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিলে সেলাই শুকানোর গতি কমে যেতে পারে। তাই দিনে কমপক্ষে ৬-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত।

৫. অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারকে জানানো

নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে দেরি না করে ডাক্তার দেখানো উচিত:

  • সেলাইয়ের স্থান লালচে হয়ে যাওয়া বা ফুলে যাওয়া।
  • অতিরিক্ত ব্যথা বা জ্বালা অনুভব করা।
  • দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ বের হওয়া।
  • জ্বর অনুভব করা।

সিজারের পর কী কী খাওয়া যাবে না?

সিজারের পর মায়ের শরীর এক নতুন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যায় শরীরে ব্যথা, দুর্বলতা, সন্তানের যত্ন নেওয়ার চাপ, সব মিলিয়ে দিনগুলো কঠিন হয়ে ওঠে। এ

ই সময় যদি ভুল খাবার খাওয়া হয়, তাহলে সেলাই শুকাতে দেরি হতে পারে, হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং শরীরে নতুন জটিলতা তৈরি হতে পারে। তাই সুস্থতার জন্য কিছু খাবার এড়িয়ে চলা অত্যন্ত জরুরি।

১. ঝাল ও মসলাযুক্ত খাবার

ঝাল-মসলাযুক্ত খাবার যেমন মরিচ, গরম মসলা, তেলেভাজা খাবার পেটে গ্যাস তৈরি করতে পারে, হজমে সমস্যা করতে পারে এবং বুক জ্বালাপোড়ার কারণ হতে পারে। এসব খাবার নবজাতকের বুকের দুধের মাধ্যমেও প্রভাব ফেলতে পারে, ফলে শিশুর পেটব্যথা হতে পারে।

২. গ্যাস সৃষ্টি করে এমন খাবার

বিরিয়ানি, চানা, মটরশুঁটি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, বেগুন ও অন্যান্য গ্যাস উৎপাদনকারী খাবার হজমে সমস্যা করে এবং সেলাইয়ের জায়গায় চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই অন্তত ২-৩ সপ্তাহ এগুলো এড়িয়ে চলাই ভালো।

৩. ক্যাফেইন ও সফট ড্রিংকস

চা, কফি, কোলা বা এনার্জি ড্রিংকস শরীরকে ডিহাইড্রেট করে এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। নতুন মায়েদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও তরল গ্রহণ করা জরুরি, তাই ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা ভালো।

৪. বেশি চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার

চিনি ও অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে নিরাময়ের গতি কমিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে, যদি কারো ডায়াবেটিস বা ইনসুলিনের সমস্যা থাকে, তবে এটি আরও বিপজ্জনক হতে পারে।

৫. ভাজাপোড়া ও ফাস্টফুড

খিচুড়ি বা সিদ্ধ খাবারের পরিবর্তে যদি মায়েরা বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, কাচ্চি, পরোটা ইত্যাদি খেতে শুরু করেন, তাহলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে এবং হজমের সমস্যা দেখা দেবে।

৬. অতিরিক্ত দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার

অনেক সময় দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার যেমন পনির, দই, মাখন ইত্যাদি খেলে গ্যাস ও বদহজম হয়। তাই যদি এসব খাবার খেয়ে অস্বস্তি হয়, তবে তা পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।

৭. কাঁচা ও অপরিষ্কার খাবার

ফলমূল বা সবজি ভালোভাবে না ধুয়ে খেলে ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা নতুন মায়ের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে। তাই সব সময় পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া উচিত।

নতুন মায়েদের জন্য কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)

১. সিজারের পর কতদিন বিছানায় বিশ্রাম নিতে হবে?

কমপক্ষে সপ্তাহ হালকা বিশ্রাম, তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

২. সিজারের পর কতদিন পরে গোসল করা যায়?

সাধারণত ৩-৫ দিন পরে, তবে ক্ষত শুকানো নিশ্চিত হওয়া জরুরি।

৩. সেলাইয়ের উপর চুলকানি হলে কি করবো?

চুলকানি হলে হাত দিয়ে ঘষা যাবে না। এটি নিরাময়ের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে বেশি হলে ডাক্তারকে দেখানো উচিত।

৪. সিজারের পর ব্যথা কমানোর উপায় কী?

ডাক্তারের পরামর্শে ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া, গরম সেঁক দেওয়া এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া দরকার।

প্রত্যেক মায়ের দেহ আলাদা, তাই সিজারের সেলাই শুকানোর সময়ও ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। ধৈর্য ধরে, সঠিকভাবে যত্ন নিলে দ্রুত সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব। লাবণীর মতো আপনিও কিছুদিনের মধ্যেই ব্যথামুক্ত জীবন উপভোগ করবেন, শুধু দরকার একটু যত্ন আর সচেতনতা

আপনার যদি আরও প্রশ্ন থাকে, কমেন্টে জানাতে পারেন বা ডাক্তারের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না।

সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।

জেনে নিন: নতুন বাচ্চার প্রয়োজনীয় জিনিস

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top